ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

নবজাগরণে  লালন দর্শন চিরকালই প্রাসঙ্গিক

তানভীর সুমন

প্রকাশিত : ১৯:০৯, ১৭ অক্টোবর ২০২৩ | আপডেট: ১৯:১০, ১৭ অক্টোবর ২০২৩

আজ লালন সাঁইজির ১৩৩ তম তিরোধান দিবস। সাঁইজির আখড়া বাড়িতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে  এসেছে  লাখো ভক্ত। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের যৌথ উদ্যোগে ৩ দিনব্যাপী আয়োজন করা হয়েছে লালন উৎসবের। বাউল গান, সাধুসঙ্গসহ  বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবেন ভক্তরা  । উৎসবকে কেন্দ্র করে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসক।

মানবিক লালন চিরকালই ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, তাইতো জাতপাত নির্বিশেষে গিয়েছেন মানুষের জয় গান। বলেছেন সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।ধর্মচেতনা মধ্যযুগীয় মরমি সাধকদের যে আবির্ভাব ঘটেছিল তার মধ্যে লালন সাঁইজি অন্যতম। ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। তাঁর কণ্ঠে সর্বদাই ধ্বনিত হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান।

লালন সাঁইথির জন্ম প্রায় ২৪৯ বছর আগে।তার জন্ম কোথায় তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও তিনি নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। কিছু সূত্রে পাওয়া যায় লালন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং লালন সাঁই ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেকে তিনি পেটের সমস্যা সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গান-বাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে , কিছু সময় পরই তিনি দেহ ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু পর কোন ধর্মীয় রীতিতে নয়, তার ইচ্ছা অনুসারে ছেউড়িয়ায় তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি  গড়ে তোলা হয়।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনো  দেখা যায়নি। লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়।  লালনের সকল ধর্মের লোকেই সম্মান করতেন। মুসলমানদের সাথে তার সুসম্পর্কের কারণে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করতেন। আবার বৈষ্ণবধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতেন। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তার শিষ্যরা তাকে “সাঁই” বলে সম্বোধন করতেন। তিনি প্রতি শীতকালে আখড়ায় একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। যেখানে সহস্রাধিক শিষ্য ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন এবং সেখানে সংগীত ও ভাব তত্ত্ব আলোচনা হত।  বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক লালন ফকিরের শিষ্য ছিলেন।লালনের শিষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাঞ্জু শাহ, ভোলাই শাহ, মলম শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দিন।

লালন তাঁর গানে আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদ বিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা ও সূক্ষ্ম ভাবে তুলে ধরে। লালনের গানের জন্য উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। তিনি কখনোই জাতিত্বের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ থাকতে চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতি ও জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে আলাদা, অকর্মণ্য এবং কূপমণ্ডূক করে রাখে। 

মানবধর্ম আর মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার সার্থক রূপকার লালন সাঁই কেবল মানবাত্মার মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করেননি তাঁর সাধনার মূলমন্ত্র ছিল নিজেকে চেনো’। দেহের ভেতর আত্মার বসতি। সবাই টের পেলেও সে আত্মাকে কেউ স্পর্শ করেনি কিংবা  দেখতে পায়নি। তাইতো 
তিনি বলেন-
কে কথা কয় রে দেখা দেয় না?
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনমভর মেলে না।

 উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শিক্ষিত সমাজে তার প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে ঠাকুর পরিবার বড় ভূমিকা রাখেন। ধারণা করা হয় ঠাকুর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল।
সাম্প্রদায়িক ধর্মবাদীরা লালনের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তার সর্বাধিক সমালোচনা করে থাকে। লালন তার জীবদ্দশায় নিজের ধর্ম পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ করেন নি। তার ধর্মবিশ্বাস আজও একটি বিতর্কিত বিষয়। তিনি গুরুকে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি ভাবতেন।লালনের অসাম্প্রদায়িকতা, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা ইত্যাদির কারণে তাকে তার জীবদ্দশায় ধর্মান্ধ এবং মৌলবাদী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘৃণা, বঞ্চনার এবং আক্রমণের শিকার হতে হয় এবং তাকে নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।

সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে। তার ধারনা গুরু ঈশ্বরেরই প্রতিচ্ছায়া। গুরুকে ভক্তি শ্রদ্ধা জানালে তা ঈশ্বরকেই জানানো হয়। গুরু ছাড়া কোন সাধনা সাধ্য হয় না।  তাই মানুষকে বিভক্তির বেড়াজালে না জড়িয়ে শুধু মানুষ হিসেবে,  মানুষকে গুরুভাবে ভজতে বলেছেন। কারণ, তাতেই লুকায়িত রয়েছে শাশ্বত প্রেমের অমিয়ধারা, মানবমুক্তি যার ফল। বর্তমান যুগে তিনি মানুষকে দেখেছেন অবতার হিসেবে। বলেছেন, দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তা জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানব সেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে জ্ঞান।

তাইতো প্রতিবছর দোল পূর্ণিমা ও সাঁইজির  তিরোধান দিবসে লাখো ভক্তের সমাগম হয় এবং সাধু সঙ্গের মাধ্যমে তারা নিজের দেহকে শুদ্ধি করার চেষ্টা করেন।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি